সবচেয়ে বড় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা হয়েছে নারীশিক্ষার প্রসারে। ১৯৭২ সালে মাধ্যমিক স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীর প্রতি ১০ জনে ১ জন ছিল নারী। ইতিমধ্যে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়লেও বর্তমানে ছাত্রীরা সংখ্যায় ছাত্রদের ছাড়িয়ে গেছে! যে পরিমাণ ছাত্রী ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিত, গত তিন দশকের কম সময়ে তাদের সংখ্যা এখন পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৪ লাখ নারী মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করছে।
তবে ছাত্রছাত্রী ভর্তিতে এই অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হলেও আত্মপ্রসাদ লাভের মতো কোনো পরিস্থিতি কিন্তু নেই। কারণ, মাধ্যমিক স্তরে পড়ার বয়সী অর্থাৎ ১১-১৫ বছর বয়সী বালক–বালিকার প্রায় এক–তৃতীয়াংশই এখনো স্কুলের বাইরে আছে।
|২.
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) চার নম্বর লক্ষ্য শিক্ষাবিষয়ক। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে সাতটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী এবং সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন ছাড়া অনেক দেশের পক্ষেই এসব লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। যেমন সাতটি লক্ষ্যের প্রথমটি হলো, ‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সব বালক–বালিকা যাতে ফ্রি, বৈষম্যহীন ও মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত সমাপ্ত করতে পারে এবং প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর শিখন ফল অর্জন করে, তা নিশ্চিত করা। ’ অথচ সম্প্রতি ইউনেসকোর এক প্রক্ষেপণে দেখা যাচ্ছে যে দ্রুত বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি না হলে, আগামী ২০৩০ সালেও বিশ্বে ৬-১৭ বছরের শিশুদের ৬ জনের ১ জন স্কুলের বাইরে থাকবে। ১২ বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করবে ১০ জনে মাত্র ৬ জন। বর্তমানে বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নামমাত্র বাধ্যতামূলক এবং কেবল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবৈতনিক। এ অবস্থা থেকে অবশিষ্ট ১১ বছরে প্রথম লক্ষ্যটি অর্জন করা খুব সহজ না হলেও সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই ধাপে ধাপে এগোতে হবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজারের বেশি, কিন্তু মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ৬ হাজারের কম। এই প্রেক্ষাপটে অধিক সংখ্যক শিশুর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুবিধার্থে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষানীতি ২০১০-এও তা-ই করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় সবচেয়ে বড় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা হয়েছে নারীশিক্ষার প্রসারে। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা আজ ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ৯৬ শতাংশ শিশু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। তাই শিশুদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রসারিত করার পক্ষে এখন কোনো যুক্তি নেই। তবে যেখানেই পড়ুক, সব শিশু যাতে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শেষ করে, তা নিশ্চিত করা এখন আগের চেয়ে অনেক জরুরি।
এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার বৈতরণি পার হয় না। মোট হিসাবে বাংলাদেশের ৬ বছর বয়সী ১০০ শিশুর মধ্যে মাত্র ৪৫ জন এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে। বিপুল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রীর স্কুলে নিয়ে আসার সাফল্যের প্রেক্ষাপটে এই হিসাব উদ্বেগজনক বৈকি। শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যে প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, তাকে ‘মৌলিক শিক্ষা’ হিসেবে বিবেচনা করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবিলম্বে ফ্রি ও বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে, সব শিশুর জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা ও আরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অন্তত দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করা ছাড়া সেই লক্ষ্য অর্জনের ভিত্তি নির্মিত হবে না।
৩.
আমাদের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার খরচ কম। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বিপুল অংশকেই সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। সম্প্রতি ৩৩২টি বেসরকারি স্কুলকে সরকারি করার এবং কয়েকটি নতুন সরকারি স্কুল নির্মাণের পরও বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের সরকারি স্কুলের সংখ্যা এখন মাত্র ৬৬৫।
বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীর মাত্র ৬.৩ শতাংশ সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অবশিষ্ট ৯৩.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে ১৯ হাজার ৮০২টি বেসরকারি স্কুলে। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসারের জন্য আরও অনেক নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন কিংবা বেসরকারি বিদ্যালয়কে সরকারি করা প্রয়োজন। হাওর, চর, চা-বাগান ও পাহাড়ি এলাকায় স্কুলের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সেদিকে বিশেষ নজর না দিলেই নয়।
৪.
সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৫০ হলেও বেসরকারি স্কুলে এই অনুপাত ১:৪৭। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই এই গড় হিসাব একটি বৈষম্যের চিত্র আড়াল করে। বড় শহরের সরকারি স্কুলে শিক্ষকের কোনো পদ খালি থাকে না, উপরন্তু সংযুক্তি ইত্যাদির আড়ালে দূরবর্তী অনেক স্কুলের শিক্ষকও এসব স্কুলে কাজ করেন। কিন্তু প্রান্তিক এলাকার সরকারি স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি লেগেই থাকে। বিভিন্ন সময় যথেচ্ছ বেসরকারি স্কুল–কলেজ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ায় দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এখন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বেসরকারি স্কুল স্থাপিত হয়েছে। এসব স্কুলের অনেকগুলোতেই শিক্ষক থাকলেও ছাত্রছাত্রী নিতান্তই নগণ্য। পাবলিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীও পাস করে না—এমন স্কুলেরও অভাব নেই। অথচ শহরাঞ্চলে অনেক বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি। এ ধরনের স্কুলে অতি স্বল্প বেতনে কিছু অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হয়।
৫.
বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যথেচ্ছ বেতন ও ফি আদায়, এমনকি পাবলিক পরীক্ষার জন্য বোর্ড নির্ধারিত ফির চেয়ে অনেক বেশি ফি আদায়ের অভিযোগসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়মিত পাওয়া যায়। এর সবকিছুই হয় ম্যানেজিং কমিটির পৌরোহিত্যে। কিছু ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্ম্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তটস্থ থাকতে হয়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা সদস্য হওয়ার জন্য কিছু লোকের দাপাদাপি ও তদবির এবং ঢাকার নামকরা বেসরকারি বিদ্যালয়ের অভিভাবক কমিটির সদস্য নির্বাচনে প্রার্থীদের বিপুল অর্থব্যয় এই ইঙ্গিতই দেয় যে এসব স্কুলের ম্যনেজিং কমিটির সদস্য হওয়ার সঙ্গে বিলক্ষণ উত্তম প্রাপ্তিযোগ রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে ভর্তি-বাণিজ্য একটি ওপেন সিক্রেট। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা এই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
৬.
প্রাথমিক হোক আর মাধ্যমিকই হোক, বাংলাদেশের শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘শিখন-সংকট’। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই এটি একটি বড় সমস্যা। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর এক বৃহৎ অংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য নির্ধারিত শিখনফল অর্জন করে না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রচারিত ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির বিভিন্ন লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট বা শিখন-মূল্যায়নে এই সংকটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আবার এই শিখন-সংকটের সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যের যোগাযোগ আছে। নানা জরিপে দেখা গেছে, শহরের অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুদের থেকে গ্রামের দরিদ্র শিশুরা শেখে কম। শেখার এই ঘাটতির কারণে তারা পিছিয়ে যায় এবং দলে দলে ঝরে পড়ে।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পাবলিক পরীক্ষাভিত্তিক। এখানে শেখার চেয়ে পরীক্ষায় পাসই মুখ্য। তাই পাবলিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন মাথায় রেখেই স্কুলে পড়াশোনা হয়। আর এ ধরনের ‘টেইলর-মেইড’ পড়াশোনার জন্য হাত বাড়ালেই নোটবই ও পা বাড়ালেই কোচিং সেন্টার তো আছেই।
শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা দেখায় অনেক শিক্ষকের দক্ষতার ঘাটতি এবং ছাত্রদের মতো শিক্ষকদেরও গাইড বই–নির্ভরশীলতার কারণে তা সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির যথাযথ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
৭.
মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকার বিদ্যালয়ের ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন, বেসরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের শতভাগ সরকার কর্তৃক প্রদান, বেসরকারি বিদ্যালয়ে সরকার অনুমোদিত শিক্ষকের পদসংখ্যা বৃদ্ধি, সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, বিদ্যালয়ে কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষকদের দেশে এমনকি বিদেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব শর্ত যুগপৎভাবে ক্রিয়াশীল না থাকায় শিক্ষার সামগ্রিক মানের ওপর এসবের প্রভাব নিতান্তই খণ্ডিত ও সাময়িক হতে বাধ্য।
শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব শর্তকে যুগপৎভাবে ক্রিয়াশীল করার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বত্র দায়বদ্ধ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা ছাড়াও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন প্রয়োজন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এর জন্য সবচেয়ে জরুরি দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস